উচ্চ মাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের নতুন সিলেবাসে বাংলা প্রথম ভাষা গুরুত্বপূর্ণ গল্প পাঠ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ পোড়া’ – ছোট গল্পটি। আজকের ক্লাসে আমরা এটি নিয়েই সম্পূর্ণ বিস্তারিত আলোচনা করব – তোমাদের সুবিধার জন্য বলে দিয়ে থাকি গল্প থেকে তোমাদের ৫ নম্বরের একটি বড় প্রশ্ন আসবে। আজকের এই ক্লাসের নোটগুলি ভালোভাবে ফলো করলে, তোমরা এই পাঁচ নম্বর খুব সহজেই পেয়ে যাবে।
সবার প্রথমে তোমাদেরকে পাঠের গল্পটি অবশ্যই ভালো করে একবার রিডিং পড়তে হবে, এটি একটি ভৌতিক গল্প – তাই অবশ্যই তোমাদের পড়তেও ভালো লাগবে – গল্পটা ভালো করে পড়া হয়ে গেলে তারপর এই নোটস বা প্রশ্ন উত্তর আলোচনাগুলো দেখলে বেশি কার্যকরি হবে। সবার প্রথমে আমরা লেখক পরিচিতি আলোচনা করব, তারপর বিষয়বস্তু, নামকরণের সার্থকতা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
‘হলুদ পোড়া’ – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (লেখক পরিচিতি)
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তবে তিনি মানিক ডাকনামেই পরিচিত ছিলেন।
তিনি ১৯০৮ সালের ১৯ মে বর্তমান ভারতের ঝাড়খণ্ডের দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের নিকট মালবদিয়া গ্রামে। পিতা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা।
ছাত্রজীবনে তিনি গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করলেও বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে লেখা তাঁর প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ ১৯২৮ সালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
তিনি বাংলা সাহিত্যে মানুষের অন্তর্জীবন, মনোলোক বিশ্লেষণ এবং সমাজ বাস্তবতার অনুসন্ধানে শক্তিমত্তা দেখিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ অন্যতম।
‘হলুদ পোড়া’ তাঁর রচিত একটি ছোটগল্প, যা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫২ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয়েছিল।
‘হলুদ পোড়া’ সম্পূর্ণ গল্পের বিষয়বস্তু (সংক্ষিপ্ত সার)
গল্পের শুরু হয় কার্তিক মাসে হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুটো খুনের ঘটনাকে ঘিরে। প্রথমে খুন হন বলাই চক্রবর্তী—তিনি ছিলেন এক মধ্যবয়স্ক/মাঝ-বয়সি যোয়ান মদ্দ পুরুষ। তিন দিন পর খুন হয় শুভ্রা, ষোল-সতের বছরের এক ভীরু স্বভাবের মেয়ে। এই দুটি মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্ক কী?—তা নিয়ে গোটা গ্রাম জুড়ে নানা গুজব, সন্দেহ ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। শুভ্রার বিবাহ হয়ে গিয়েছিল এবং বছর দেরেক সে তার শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। পরে সাত মাসের গর্ভবতী অবস্থায় সে বাপের বাড়ি আসে, তার দাদা ধীরেন চাটুয্যের কাছে, ধীরেনের স্ত্রী ছিলেন শান্তি। আর বলাই চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর তাঁর ভাইপো নবীন চক্রবর্তী বলাইয়ের সমস্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। নবীনের স্ত্রী ছিলেন দামিনী।
গ্রামের বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে কেউই গুরুতর যখন হয়নি সেইখানে পরপর দু’দুটো খুন হয়ে গেছে। শুভ্রার মৃত্যুর পর পাড়ায় নানা গুজব ছড়াতে থাকে। একুশ দিন পর, এক সন্ধ্যায় দামিনীর ওপর শুভ্রার অশরীরী আত্মা ভর করে। তখন নামকরা গুণী কুঞ্জকে ডেকে আনা হয়। কুঞ্জ যখন কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে তার নাকের কাছে ধরেন, তখন দামিনীর কণ্ঠে শোনা যায় শুভ্রার স্বীকারোক্তি— “আমি শুভ্রা.. আমায় মেরো না… বলাই খুড়ো আমায় খুন করেছে।”
কিন্তু সমস্যা হলো—বলাই তো শুভ্রার খুনের তিন দিন আগেই মারা গেছে! ফলে রহস্য আরও গভীর হয়। দামিনীর মুখ দিয়ে শুভ্রার আত্মা বলাই চক্রবর্তীর নাম করলে গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বুড়ো ঘোষাল ব্যাখ্যা করে—শুধু জ্যান্ত মানুষ গলা টিপে মারে না, অশরীরীরাও মাঝে মাঝে ক্ষতি করতে পারে। তবে কুঞ্জ গুণীর মতে, মরার পর এক বছরের মধ্যে সরাসরি মানুষ খুন করা সম্ভব নয়; তাই বলাই কারো শরীরে ভর করেই শুভ্রাকে খুন করেছে।
এইসব কথাবার্তা দ্রুত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরেনও গুজবগুলো শোনে, কিন্তু নিজের বোনের কেলেঙ্কারির কথা বারবার শুনে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। অগ্রহায়ণের রোদেলা দিনে, ঘাটে শুভ্রার ওঠা–নামার জন্য বানানো ধাপ, ডোবার ধারে কচুরিপানা আর চারদিকের দৃশ্য দেখে ধীরেনের মনে নানা ভাবনা জাগে। ক্ষোভ ও দুঃখে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
শান্তি (ধীরেনের স্ত্রী) একসময় নিজের ধারণা প্রকাশ করলে ধীরেন তাকে ধমক দেয়। চারপাশের মানুষ তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়, এমনকি স্কুলের হেডমাস্টারও তাকে এক মাসের ছুটি নিতে বলেন। এতে ধীরেন আরও ভেঙে পড়ে, নিজেকে একঘরে মনে হয়।
ধীরেন বাড়ি ফিরে আসে এবং সারাদিন মানসিক অস্থিরতায় কাটায়। সন্ধ্যা নামতেই ভয় আরও বাড়তে থাকে। শান্তি ছেলেমেয়েদের ঘরে আটকে রাখে, এমনকি ধীরেনকেও একা বাইরে যেতে মানা করে। তাদের ভয়ের পরিবেশ এত প্রবল হয় যে অল্পতেই শান্তি আঁতকে ওঠে—একবার পেঁচার ডাক শুনে সে ভয় পেয়ে ধীরেনকে আঁকড়ে ধরে বমি করে ফেলে।
এরপর ক্ষেন্তি পিসির কথামতো একটি নতুন বাঁশ কেটে, তার আগা–মাথা পুড়িয়ে আড়াআড়িভাবে ঘাটের পথে ফেলে রাখা হয়। বিশ্বাস ছিল, অশরীরী এই বাঁশ পার হতে পারবে না। ফলে শুভ্রা যদি ঘাট থেকে বাড়ির দিকে আসতেও চায়, সে বাঁশ পর্যন্ত এসে ঠেকবে।
শান্তি সন্ধ্যার আগে সমস্ত ঘরের কাজ সেরে নেয়, তাড়াহুড়ো করে প্রদীপ জ্বালে, শাঁখ বাজায়, এমনকি রান্না-বাসনের ধরনও বদলে ফেলে—যেমন মাছ রান্না বন্ধ করে দেয়, কারণ এটোকাঁটা নাকি অশরীরীকে টানে।
ঘরে বন্দী হয়ে ধীরেন অস্থিরভাবে চিন্তায় ডুবে থাকে। সন্তানদের কথাবার্তায়ও ভয়ের ছাপ দেখা যায়—তারা বলে, “ছোটপিসি ভূত হয়েছে।” ধীরেন বলে, “ভূত নয়, পেত্নী।”
এইভাবে ধীরেন ও তার পরিবারের দিনযাপন ভয়ে-আতঙ্কে কাটতে থাকে। সন্ধ্যা নামলেই ঘরে আতঙ্ক আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা থেকে ধীরেনের পরিবারের কারও ওই আগা–মাথা পুড়িয়ে আড়াআড়িভাবে ঘাটের পথে ফেলে রাখা বাঁশ ডিঙ্গিয়ে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু একদিন আকাশে তখনও শেষ আলো মিলিয়ে যায়নি, ধীরেন ভাবে—জীবিত ও মৃতের সংযোগ স্থাপনের সবচেয়ে প্রশস্ত সময় হলো সন্ধ্যা। ভরসন্ধ্যাতেই যেহেতু শুভ্রা দামিনীকে ভর করেছিল, তাই ধীরেন মনে করে তার সঙ্গে শুভ্রার কথা বলার সুযোগ দেওয়া/পাওয়া উচিত। এই ভেবেই সে বাঁশ ডিঙ্গিয়ে মাঠের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ শোনা যায় হিংস্র জন্তুর গর্জনের মতো আওয়াজ। শান্তি তখন বলে ওঠে— “বাঁশটা ডিঙ্গিয়ে চলে এসো! পড়ে গেছো নাকি?”, ধীরেন উত্তর দেয়— “ডিঙ্গোতে পারছি না। বাঁশ সরিয়ে দাও।” এরপর ধীরেন তীক্ষ্ণ গলায় আর্তনাদ শুরু করে। শান্তি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যায় যে কোনো অশরীরী শক্তি তাকে ভর করেছে।
তখন চারদিক থেকে গ্রামের লোকজন জড়ো হয়। আসে গুণী কুঞ্জ। মন্ত্রপাঠ, আগুনে শিকড়-পাতা পোড়ানো আর ঘণ্টাখানেকের চেষ্টা শেষে তিনি ধীরেনকে শান্ত করতে সক্ষম হন। এরপর কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে ধীরেনের নাকে ধরে তুই কে? জিজ্ঞাসা করলে ধীরেনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে আসল সত্য— “আমি বলাই চক্রবর্তী! শুভ্রাকে আমি খুন করেছি।” অর্থাৎ, ওই সন্ধ্যা বেলাতে বলাই চক্রবর্তীর অশরীরী আত্মা বা ভূত ধীরেনের উপর ভর করে।
‘হলুদ পোড়া’ গল্পের মুখ্য চরিত্র আলোচনা
বলাই চক্রবর্তী → এক মধ্যবয়স্ক/মাঝ-বয়সি যোয়ান মদ্দ পুরুষ, যার প্রথম খুন হয়। তার অশরীরী আত্মা পরে ধীরেনের উপর ভর করে এবং সে নিজেই স্বীকার করে—“আমি বলাই চক্রবর্তী! শুভ্রাকে আমি খুন করেছি।” কুঞ্জ গুণীর মতে, সরাসরি খুন করার ক্ষমতা মরার এক বছরের মধ্যে জন্মায় না; তাই বলাই অন্য কাউকে ভর করেই শুভ্রাকে খুন করেছে।
শুভ্রা → ষোল-সতের বছরের এক ভীরু স্বভাবের মেয়ে। শুভ্রার বিবাহ হয়ে গিয়েছিল এবং বছর দেরেক সে তার শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। পরে সাত মাসের গর্ভবতী অবস্থায় সে বাপের বাড়ি আসে, তার দাদা ধীরেন চাটুয্যের কাছে। বলাই চক্রবর্তী খুনের তিনদিন পরেই শুভ্রা খুন হয়, এবং পরবর্তীতে এক সন্ধ্যায় নবীনের স্ত্রী দামিনীর ওপর শুভ্রার অশরীরী আত্মা ভর করে দামিনীর কণ্ঠে শোনা যায় শুভ্রার স্বীকারোক্তি— “আমি শুভ্রা.. আমায় মেরো না… বলাই খুড়ো আমায় খুন করেছে।” তার মৃত্যুর পরে গ্রামে নানা গুজব ছড়ায়, ধীরেনের ছেলেমেয়েরা তাকে “ভূত বা পেত্নী” বলে উল্লেখ করে।
নবীন চক্রবর্তী → বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো। বলাই খুন হওয়ার পরে তার সমস্ত সম্পত্তি নবীনের দখলে যায়। সে সহরের চল্লিশ টাকার চাকরী ছেড়ে সপরিবারে গাঁয়ে/গ্রামে এসে বসবাস করতে থাকে।
দামিনী চক্রবর্তী → নবীনের স্ত্রী। এক ভর সন্ধ্যায় তার ওপর শুভ্রার অশরীরী আত্মা ভর করে। দামিনীর কণ্ঠে শোনা যায় শুভ্রার স্বীকারোক্তি— “আমি শুভ্রা.. আমায় মেরো না… বলাই খুড়ো আমায় খুন করেছে।”
ধীরেন চাটুয্যে → শুভ্রার দাদা। ধীরেন গ্রামে একমাত্র ডাক্তার পাশ-না-করা, ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বি. এসসি পাস করে সাত বছর গ্রামের/স্থানীয় স্কুলে জিওগ্রাফি পড়াচ্ছেন। শুভ্রার স্বীকারোক্তিতে সব দোষ এসে পড়ে ধীরেন চাটুয্যের ওপর, এবং তাকে ঘিরে গ্রামে নানা কটুক্তি শুরু হয়। ধীরে ধীরে ধীরেন গ্রামে অপমান ও ব্যঙ্গের পাত্র হয়ে এবং গ্রামে একঘরে হয়ে পড়ে। একদিন আকাশে তখনও শেষ আলো মিলিয়ে যায়নি, তিনি ভাবে—জীবিত ও মৃতের সংযোগ স্থাপনের সবচেয়ে প্রশস্ত সময় হলো সন্ধ্যা। ভরসন্ধ্যাতেই যেহেতু শুভ্রা দামিনীকে ভর করেছিল, তাই তিনি মনে করে তার সঙ্গে শুভ্রার কথা বলার সুযোগ দেওয়া/পাওয়া উচিত। সন্ধ্যাবেলায় বাঁশ ডিঙিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করে এবং তখন তার উপর বলাই চক্রবর্তীর আত্মা ভর করে।
শান্তি → ধীরেনের স্ত্রী। সবসময় ভয়-আতঙ্কে দিন কাটায়। সন্ধ্যার পর একা বাইরে বেরোয় না, ছেলেমেয়েকেও ঘরে আটকে রাখে। ক্ষান্তি পিসির পরামর্শে নতুন বাঁশ কেটে আগা-মাথা পুড়িয়ে ঘাটের পথে আড়াআড়ি ফেলে রাখে—যাতে অশরীরী আত্মা ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। শেষে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে বোঝে যে ধীরেনকে অশরীরী ভর করেছে।
কুঞ্জ → গ্রামের নামকরা গুণী। দামিনী ও পরে ধীরেনকে ভূতগ্রস্ত অবস্থা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। মন্ত্রপাঠ, শিকড়-পাতা পোড়ানো, আগুনে জল ছিটানো এবং শেষে কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে নাকে ধরার মাধ্যমে সত্য বের করে আনে।
কৈলাস ডাক্তার → এক বিশালকায় মানুষ, জমকালো চেহারা, মোটা ভুরু ও খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি, একমাথা কাঁচাপাকা চুল। ঘুমের ওষুধ বা চিকিৎসার প্রক্রিয়ায় পারদর্শী, কিন্তু রাগে সহজে উগ্র হয়ে ওঠে, গর্জন করতে ভালোবাসে এবং অন্যদের উপর আধিপত্য দেখায়।
ক্ষেন্তি পিসি → গ্রামের এক বৃদ্ধা মহিলা, যিনি উপায় বাতলে দেন বাঁশ কেটে আগা-মাথা পুড়িয়ে ঘাটের পথে ফেলে রাখতে। বিশ্বাস ছিল, কোনো অশরীরী এই বাঁশ ডিঙোতে পারবে না।
বুড়ো ঘোষাল → গ্রাম্য মানুষ। তিনি ব্যাখ্যা দেন—মরা মানুষও মাঝে মাঝে মানুষের ক্ষতি করতে পারে, এতে অনেকের সন্দেহ কেটে যায়। তবে তার ব্যাখ্যা কুঞ্জ গুণীকে ঘুরিয়ে সমর্থন করতে হয়, নিজের মর্যাদা রক্ষার জন্য।
পুরোহিত (পুরুতঠাকুর) → গ্রামের পুরোহিত। তিনি ধীরেনকে দোষমোচনের জন্য ক্রিয়াকর্ম করার পরামর্শ দেন এবং মাদুলি ধারণ করার নির্দেশ দেন।
মথুরবাবু → স্কুলের সেক্রেটারি। তিনিই হেডমাস্টারকে বলেন ধীরেনকে এক মাসের ছুটি দিতে।
সম্পর্ক
বলাই চক্রবর্তী (কাকা) → নবীন চক্রবর্তী (ভাইপো)
দামিনী → নবীনের স্ত্রী, অর্থাৎ বলাইয়ের ভাইপোর বউ।
শুভ্রা (বোন) → ধীরেন চাটুয্যে (দাদা)
শান্তি → ধীরেনের স্ত্রী, অর্থাৎ শুভ্রার ভ্রাতৃবধূ।
‘হলুদ পোড়া’ গল্পের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর আলোচনা।
নিচে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেওয়া হলো – যেগুলি সরাসরি তোমাদের পরীক্ষাতে আসতে পারে, পরীক্ষাতে আংশিক বা লাইন তুলে উক্তি হিসেবে প্রশ্ন আসতে পারে – নিচের উত্তরটি ভালো করে করে গেলে যে কোন প্রশ্ন আসুক তোমরা কিন্তু লিখে আসতে পারবে। আর উপরের বিষয়বস্তু তাতে তোমরা ভালো করে পড়ে যাচ্ছো চরিত্রের নাম গুলো করে যাচ্ছ কাজে কোন রকম অসুবিধা হবে না।
প্রশ্ন: ছোট গল্প হিসেবে ‘হলুদ পোড়া’ গল্পটি কতদূর সার্থক তা নিজের ভাষায় আলোচনা কর। ★★★ সংসদ নমুনা প্রশ্ন
অথবা, ‘হলুদ পোড়া’ ছোট গল্পটির ‘নামকরণের সার্থকতা‘ বিশ্লেষণ কর। ★
উত্তর: বিখ্যাত সাহিত্যিক ও কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘হলুদ পোড়া’ গল্পটি বাংলা ছোটগল্প সাহিত্যের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এটি একদিকে লোক-কথা মূলক গল্প আবার অন্যদিকে ভৌতিক আবহে মোড়ানো, যেখানে গ্রামীণ সমাজের কুসংস্কার, রহস্য, ভয় এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব/মানসিকতা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
গল্পের শুরু হয় কার্তিক মাসে হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুটো খুনের ঘটনাকে ঘিরে। প্রথমে খুন হন বলাই চক্রবর্তী—তিনি ছিলেন এক মধ্যবয়স্ক/মাঝ-বয়সি যোয়ান মদ্দ পুরুষ। তিন দিন পর খুন হয় শুভ্রা, ষোল-সতের বছরের এক ভীরু স্বভাবের মেয়ে। এই দুটি মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্ক কী?—তা নিয়ে গোটা গ্রাম জুড়ে নানা গুজব, সন্দেহ ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। শুভ্রার বিবাহ হয়ে গিয়েছিল এবং বছর দেরেক সে তার শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। পরে সাত মাসের গর্ভবতী অবস্থায় সে বাপের বাড়ি আসে, তার দাদা ধীরেন চাটুয্যের কাছে, ধীরেনের স্ত্রী ছিলেন শান্তি। আর বলাই চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর তাঁর ভাইপো নবীন চক্রবর্তী বলাইয়ের সমস্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। নবীনের স্ত্রী ছিলেন দামিনী।
গ্রামের বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে কেউই গুরুতর যখন হয়নি সেইখানে পরপর দু’দুটো খুন হয়ে গেছে। শুভ্রার মৃত্যুর পর পাড়ায় নানা গুজব ছড়াতে থাকে। একুশ দিন পর, এক সন্ধ্যায় দামিনীর ওপর শুভ্রার অশরীরী আত্মা ভর করে। তখন নামকরা গুণী কুঞ্জকে ডেকে আনা হয়। কুঞ্জ যখন কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে তার নাকের কাছে ধরেন, তখন দামিনীর কণ্ঠে শোনা যায় শুভ্রার স্বীকারোক্তি— “আমি শুভ্রা.. আমায় মেরো না… বলাই খুড়ো আমায় খুন করেছে।”
কিন্তু সমস্যা হলো—বলাই তো শুভ্রার খুনের তিন দিন আগেই মারা গেছে! ফলে রহস্য আরও গভীর হয়। বুড়ো ঘোষাল বলে যে, বলাই হয়তো কোনো জীবিত মানুষকে ভর করে শুভ্রাকে খুন করেছে। শুভ্রার এই স্বীকারোক্তিতে তখন সব দোষ এসে পড়ে ধীরেন চাটুয্যের ওপর, এবং তাকে ঘিরে গ্রামে নানা কটুক্তি শুরু হয়। ধীরে ধীরে ধীরেন গ্রামে অপমান ও ব্যঙ্গের পাত্র হয়ে এবং গ্রামে একঘরে হয়ে পড়ে।
এরপর গল্পের মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ক্ষেন্তি পিসি পরামর্শ দেয় যে একটি নতুন বাঁশ কেটে তার আগা ও মাথা পুড়িয়ে ঘাটের পথে আড়াআড়ি ফেলে রাখতে। কারণ কোনো অশরীরী সেই বাঁশ পার করতে পারবে না। সন্ধ্যা থেকে ধীরেনের পরিবারের কারও ওই বাঁশ ডিঙ্গিয়ে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু একদিন আকাশে তখনও শেষ আলো মিলিয়ে যায়নি, ধীরেন ভাবে—জীবিত ও মৃতের সংযোগ স্থাপনের সবচেয়ে প্রশস্ত সময় হলো সন্ধ্যা।
ভরসন্ধ্যাতেই যেহেতু শুভ্রা দামিনীকে ভর করেছিল, তাই ধীরেন মনে করে তার সঙ্গে শুভ্রার কথা বলার সুযোগ দেওয়া/পাওয়া উচিত। এই ভেবেই সে বাঁশ ডিঙ্গিয়ে মাঠের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ শোনা যায় হিংস্র জন্তুর গর্জনের মতো আওয়াজ। শান্তি তখন বলে ওঠে— “বাঁশটা ডিঙ্গিয়ে চলে এসো! পড়ে গেছো নাকি?”, ধীরেন উত্তর দেয়— “ডিঙ্গোতে পারছি না। বাঁশ সরিয়ে দাও।” এরপর ধীরেন তীক্ষ্ণ গলায় আর্তনাদ শুরু করে। শান্তি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যায় যে কোনো অশরীরী শক্তি তাকে ভর করেছে।
তখন চারদিক থেকে গ্রামের লোকজন জড়ো হয়। আসে গুণী কুঞ্জ। মন্ত্রপাঠ, আগুনে শিকড়-পাতা পোড়ানো আর ঘণ্টাখানেকের চেষ্টা শেষে তিনি ধীরেনকে শান্ত করতে সক্ষম হন। এরপর কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে ধীরেনের নাকে ধরে তুই কে? জিজ্ঞাসা করলে ধীরেনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে আসল সত্য— “আমি বলাই চক্রবর্তী! শুভ্রাকে আমি খুন করেছি।” অর্থাৎ, ওই সন্ধ্যা বেলাতে বলাই চক্রবর্তীর অশরীরী আত্মা বা ভূত ধীরেনের উপর ভর করে।
অতএব, গল্পের শুরুতেও রহস্য উন্মোচনে ‘হলুদ পোড়া’ ব্যবহৃত হয়েছে, আবার শেষেও খুনের আসল রহস্য উদঘাটনে এই ‘হলুদ পোড়া’ই ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এ সবই লোকবিশ্বাস-কুসংস্কার, তবুও এই কুসংস্কার-বিশ্বাসকেই লেখক গল্পের ভৌতিক আবহকে আরও দৃঢ় ও বাস্তব করে তুলতে নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই লোক-কথা মূলক ভৌতিক ছোটগল্পে ‘হলুদ পোড়া’ নামকরণ অত্যন্ত সার্থক। গল্পটি রহস্য, ভয় ও কুসংস্কারকে কেন্দ্র করে পাঠকের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে, এবং সার্থক ছোটগল্পের সব গুণ এতে বিদ্যমান।
উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের পরবর্তী ক্লাস এবং নোটগুলি পেতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকো, আর এটি অবশ্যই বন্ধুদেরকে শেয়ার করে দাও।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম Study গ্রুপে যুক্ত হোন -